২১শে আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পরে, পার্লামেন্টে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘ওনাকে মারতে যাবে কে?’ এমনকি তিনি এ ঠাট্টাও করেছিলেন, শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার জীবনটি খালেদার কাছে এমনই ঠাট্টা-মস্করার বিষয় ছিল সেদিন। এই ঠাট্টা-মস্করার মূল উদ্দেশ্য ছিল, তখনও খালেদা জিয়ারা নিশ্চিত ছিলেন যে, ২১শে আগস্ট ফেইল করলে কি হবে, খুব দ্রুতই তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সাক্ষাৎকার
অন্যদিকে ২১শে আগস্ট হত্যাচেষ্টায় খালেদা যে জড়িত ছিলেন তা অন্তত দু’জনের জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়। মুফতি হান্নান তার জবানবন্দীতে বলেছিল তারা তারেক রহমানের সঙ্গে দু’বার মিটিং করে এবং তারেক তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করার বিষয়টি নিশ্চিত করে। অন্যদিকে ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি রুমি তার জবানবন্দিতে বলেছিলেন তিনি খালেদা জিয়ার কাছে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ চেয়েও নির্দেশ পাননি। খালেদা জিয়ার এই তদন্তের নির্দেশ না দেয়া থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, তারেক সামগ্রিক বিষয়টি দেখভাল করছেন, এটা তিনি জানতেন। আর জানতেন বলেই তিনি তদন্ত করতে দেননি।
এই জবানবন্দিগুলো এখনাকর নয়, আওয়ামী লীগ আমলে যখন প্রকৃত অর্থে মামলার কার্যক্রম শুরু হয় তখনই উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই দুটো জবানবন্দি ছাড়াও অন্যান্য জবানবন্দিতেও খালেদা জিয়া ও তারেক যে জড়িত ছিলেন, আর খালেদাই মূল মাস্টারমাইন্ড কিংবা তারেক তাকে সব কিছু জানিয়ে হত্যাচেষ্টা অপারেশনটি সমন্বয় করেন, এটা পরিষ্কার হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের ভেতর দিয়ে যে এভিডেন্স উঠে এসেছে, তাতে খালেদা জিয়াকে ছাড় দেয়ার আর কোন সুযোগ নেই। দেশের আইনের শাসনের স্বার্থে অবিলম্বে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত করে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেয়ার সুযোগ আছে। আর ওই চার্জশিট অনুযায়ী নতুন মামলা চলার সুযোগ আছে- যা সকলে জানেন।
আমাদের যে সুশীল সমাজ ও আইনজ্ঞরা সব সময়ই দেশে আইনের শাসন চান, তাদের দাবি তোলা উচিত এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিচার হওয়ার। কারণ দিনের আলোতে রাজধানীতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে একটি গণহত্যা হলো এবং তার সঙ্গে দেশের সে সময়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যার চেষ্টা হলো- এ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ উদ্ঘাটন ও বিচার দেশের আইনের শাসনের জন্য প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন সংগঠন, পেশাজীবী সম্প্রদায় ও সুশীল সমাজের তরফ থেকে তাই অচিরেই দাবি ওঠা উচিত, সরকার যেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ মামলা চালু করে। কারণ এই মামলা যদি সরকার চালু না করে তা হলে সেটা হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা থেকে দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া।
আরও পড়ুন: ২১শে আগস্ট সফল হলে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল তারেক
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলা চালু ছাড়াও ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় আরও কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। যেমন- র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের কাছে খবর ছিল, তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই- জেএমবি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন এই পরিকল্পনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং অপারেশনে যুক্ত ছিল। এই তাজউদ্দিনকে কার বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল? সেখান থেকে কীভাবে তাকে দেশের বাইরে পাঠানো হয়? এই সহযোগীদের অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার।
কারণ, যে ঘটনায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল ওই ঘটনার কুশীলবদের আশ্রয় দেয়াও কিন্তু সমপরিমাণ অপরাধ। এর পরে দেখা দরকার ঘটনার দিন গোলাপ শাহ মাজারের ওখান থেকে হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে যারা দ্রুত সরে পড়েছিল, ওরা ধানমণ্ডির কোন্ কোন্ বাড়িতে গিয়েছিল? তারা কি শুধুই রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছিল, নাকি ওই সময়ে তারেক রহমানের ধানমণ্ডিতে গোপনে নেয়া কোনো বাড়ি ছিল কিনা- সেটাও দেখা দরকার। এ ছাড়া অন্য কোনো বাড়িতে গিয়েছিল কিনা, তাও খোঁজ নেয়া দরকার। এগুলো জনগণের সামনে উন্মোচন হওয়া দরকার। বিশেষ করে দেশে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোন হত্যাকাণ্ড না ঘটে তার জন্যই এ গুলো উদ্ঘাটিত হওয়া দরকার।
এছাড়া ওইদিন ঘটনার সময় কেন সচিবালয়ের সামনে একটি আর্মির গাড়ি ছিল? তারা কী কাজে সেখানে ছিল সেটাও জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওইদিন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক স্বদেশ রায় দায়িত্বপালনরত অবস্থায় ঘটনাস্থলে ছিলেন, তিনি এসব অসঙ্গতি এবং সন্দেহজনক বিষয় প্রত্যক্ষ করেছেন বলে লিখেছেন। সেদিন তিনি ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছে দেখতে পান সেখানে আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। কার নির্দেশে সেদিন আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হয়েছিল, সেটাও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
বাস্তবে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা বা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলা কোনোমতেই একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্য নয়। এটা মূলত দেশের থেকে একটি বিশেষ চিন্তাধারা বাস্তবে প্রগতিশীল চিন্তাধারার রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ঘটানো একটি ঘটনা। যেমনটি ঘটানো হয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট। সে ঘটনার ভেতর দিয়ে দেশের সংবিধান এমনভাবে বদলে গেছে যে, আজও আমরা সাংবিধানিকভাবে পূর্বের অবস্থানে পৌঁছাতে পারিনি। ৭৫-এর পট পরিবর্তনের ধারা থেকে দেশকে স্বাধীনতার ধারায় আনার শক্তিকে সংগঠিত করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তাই তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের হত্যার ভেতর দিয়ে মূলত এটাই কার্যকর করতে চেয়েছিল যে, স্বাধীনতার ধারার শক্তি যেন বাংলাদেশে সংগঠিত হতে না পারে।
[মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ২১শে আগস্টের হত্যাকাণ্ডে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা]
অন্যদিকে ২০০৪ সালে যেমন শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা হয়েছে, তেমনি ২০০৪ সালে দেশের ৬৩টি জেলায় ৫২৯টি স্থানে একযোগে জঙ্গীরা বোমা হামলা চালিয়ে তাদের শক্তির পরিচয় দেয়। তাই এখান থেকে বুঝতে কোন কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, ২০০৪ এ যদি খালেদা ও তারেক রহমান সফল হতেন, তারা যদি শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারতেন, তা হলে এতদিনে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো।
সাংবাদিক স্বদেশ রায় ইতোপূর্বে প্রকাশিত তার একটি কলামে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর শওকত আলী বীরপ্রতীকের সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন- যেখানে বেগম জিয়া যে মনেপ্রাণে পাকিস্থানি সেটা তিনি বলেছেন। এমনকি জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া নিয়ে তাকে গাদ্দার বলতেও দ্বিধা করেননি খালেদা জিয়া।
তিনি তারেক রহমানকে নিয়ে জিয়ার সঙ্গে না গিয়ে শেষ পর্যন্ত জানজুয়ার তত্ত্বাবধানে পাকিস্থানী সেনাদের সঙ্গেই থাকেন। অন্যদিকে ২০০১-এ তারেক রহমান বলেন, শিবির ও ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান। তারেক ইঙ্গিত করেন সেই মা খালেদা জিয়া। বস্তুত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত বিএনপির সঙ্গে জঙ্গী ও জামায়াতে ইসলামীর কোন পার্থক্য নেই। তার মানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জঙ্গী ও জামায়াতের আদর্শের অনুসারী।
২১শে আগস্টে শেখ হাসিনা নিহত হলে বাংলাদেশ যে একটি তালেবান রাষ্ট্র হয়ে যেত, তা কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকরাও ঠেকাতে পারতেন না। সে চেষ্টা করার তারা কোন সুযোগও পেতেন না। বরং তারাও এখন চিন্তা করে দেখতে পারেন, তারা যে তালেবান রাষ্ট্র নয় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বাস করছেন এটা কেবল সম্ভব হচ্ছে শেখ হাসিনা আছেন বলেই। আজ অনেকে বর্তমান সরকারের দেয়া গণতন্ত্রে মানবাধিকারে সন্তুষ্ট নন, এ অসন্তোষ গণতান্ত্রিক সমাজের একটি অলঙ্কার।
আরও পড়ুন: বাবার মতই ঠান্ডা মাথার খুনি তারেক রহমান
অর্থাৎ মানুষ আরও বেশি গণতান্ত্রিক, আরও বেশি মানবাধিকার চায়। মানুষের চাহিদা সব সময় অপরিসীম থাকবে। তবে দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিতে হবে এটা বুঝবেন রাজনীতিকরা, রাষ্ট্রনায়করা। আর যারা এখন বর্তমান গণতন্ত্র নিয়ে সমালোচনা করেন, তারাও বোঝেন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই। তাই দেশ কীভাবে এগোবে সেটা শেখ হাসিনাই ভাল বুঝবেন, আবার সমাজে সমালোচনাও থাকবে।
তবে আজ এই যে উদার সমাজ আছে, রাষ্ট্র আছে, পাশাপাশি যে উন্নয়নের ধারা এর কোন কিছুই বাংলাদেশ দেখতে পেত না যদি ২০০৪-এর ২১শে আগস্ট খালেদা-তারেকরা সফল হতো। বাংলাদেশ এতদিনে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের থেকেও খারাপ একটি দেশ হতো। সে উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয়েছিল ২১ আগস্ট।
তাই ২১ আগস্টের সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা দেশের স্বার্থে ও জাতির স্বার্থে প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: