অনেকদিন ধরেই বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর একটা মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চলছে, আর তা হলো- জিয়ার অনুগ্রহেই নাকি আওয়ামী লীগ রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিল! এমন বিভ্রান্তিকর প্রচারণাকে আরও কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে বাকশালের সাবেক সদস্য জিয়াকে মহানুভব সাজাতে কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মে রয়েছে জিয়ার অবদান!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা জিয়ার কপালে সুপার গ্লু দিয়ে তথাকথিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের খেতাব’ জুড়ে দিতে চায়, তারা বোঝেও না যে এতে উল্টো জিয়ার স্বৈরাচারী বৈশিষ্ট্যই প্রমাণিত হয়।
“রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতি” দিয়ে এবং “আমার সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক” উল্লেখ করে ক্ষমতা দখলকারী জিয়া ১৯৭৭ সালের জুন মাসে ইয়েস/নো ভোটে এবং ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন এক হাস্যকর নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এর গদিতে আরোহন করেন। তখন তিনি আইন লঙ্ঘন করে একাধারে কমান্ডার ইন চিফ, চিফ অব স্টাফ এবং চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে আসীন ছিলেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি বন্ধ করার হেন কোনো চেষ্টা নেই যা জিয়া করেননি। বিপুল সংখ্যক সমর্থক থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে হয়েছিল জিয়াকে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে দমনের জন্য বঙ্গবন্ধুর নামও যেন ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য “মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করা যাবে না” এমন শর্ত যুক্ত করেছিল। (নিয়তির নির্মম পরিহাস- তার নিজের দলই মৃত জিয়াকে দিবারাত্রি ব্যবহার করছে)।
জিয়া জানতেন গণতন্ত্র ছাড়া তাকে সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। ভিক্ষার ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতিকে সচল রাখতে গণতন্ত্রে উত্তরণের পুতুল খেলা হলেও তাকে খেলতে হবে। তাই আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন তিনি। আওয়ামী লীগের কাউন্টার হিসেবে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি ও তাদের প্রতিনিধি রাজাকার শাহ আজিজ, মাওলানা মান্নান, আবদুল আলীম ও সাকা চৌধুরীদের মতো ঘৃণ্য ব্যক্তিদের দলে যুক্ত করেন। জামায়াতে ইসলামীসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত ব্যক্তি ও দলগুলোকে রাজনীতি করার ফ্লোর দেন। কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব দেন।
আরো পড়ুনঃ বিএনপি এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিত্রহীন একটি দলে পরিণত হয়েছে
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন জিয়া। তিনি দেশে ফিরে আসার আগে বিএনপি নেতাদের তৈরি কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে না দেয়ার শপথ গ্রহণ করা হয়। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তথা ১৭ই মে কাফনের কাপড় নিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে না দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সারাদেশ থেকে ঢাকামুখী জনস্রোত দেখে সেই সমাবেশ স্থগিত করা হয়।
গণতন্ত্রের মূল শর্ত হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের নির্বাহী বিভাগের কোনো ধরণের প্রভাব থাকতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কোন দল রাজনীতি করবে, কারা অযোগ্য ঘোষিত হবে- এ জাতীয় সকল সিদ্ধান্তের এখতিয়ার শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের। কিছু ক্ষেত্রে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী এতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না।
জিয়া আওয়ামী লীগকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিল- এটা বললে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, জিয়া ছিলেন বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার যিনি বিরোধী দলে কে বা কারা থাকবে তা-ও নির্ধারণ করে দিতেন।
জিয়া আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। অনন্যোপায় হয়ে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন দেয়ার দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়ে হাসির পাত্র হলেন মির্জা আব্বাস
তবে একেবারে চুপচাপও তিনি ছিলেন না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ বাতিল করা, দলীয় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা এবং গঠনতন্ত্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে দিতে চাপ দিয়েছিলেন জিয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃবৃন্দের অনড় অবস্থানের কারণে সুবিধা করতে পারেননি জিয়া।
কিন্তু এটাও সত্যি যে, কিছু দলের পুনর্জন্মে জিয়া ভূমিকা রেখেছিলেন, যেমন- জামায়াতে ইসলামী, নেজামে পার্টি, ন্যাপ, মুসলিম লীগসহ স্বাধীনতাবিরোধী কয়েকটি গোষ্ঠী। তাই জিয়াকে কৃতিত্ব দিতে চাইলে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের পুনর্জন্মেরও কৃতিত্ব দিতে হবে।